অস্টিনের সার্বভৌমিকতা তত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি লেখ।
রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ইচ্ছাই সার্বভৌমত্ব।” সার্বভৌমত্ব হল রাষ্ট্রের চূড়ান্ত, স্থায়ী, অবিভাজ্য, অহস্তান্তরযোগ্য এবং সার্বাদীন ক্ষমতা। এ ক্ষমতাবলে সমস্ত ধাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আদেশ দান করে এবং প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দ্বারা আনুগত্য আদায় করে। মধ্যযুগে সার্ব হয় এবং আধুনিকযুগে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয়। প্রকৃত সার্বভৌমত্ব, নামমাত্র সার্বভৌমত্ব, বাস্তব সার্বভৌমত্ব, আইনানুমোদিত সার্বভৌমত্ব, আইনগত সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব এগুলি সার্বভৌমত্বের বিভিন্নমুখী প্রকাশ। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের সার্বভৌমত্ব কথাটি সকলের নিকট পরিচিত। জননেই শাসক নির্বাচন করে, শাসক পরিবর্তন করে এবং প্রয়োজনে উৎখাত করে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যেহেতু জনগণের শাসন সেহেতু এটি ব্যবস্থায় নাগরিকদের অংশ গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং জনগণের নিকট শাসকের নিশ্চিত করতে হবে। এই ইউনিটে সার্বভৌমত্ব কাকে বলে, এর বিভিন্ন রূপ, এ সম্পর্কিত, মতবাদ এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব বলতে কি বুঝায় সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
১০.১.১ সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা
সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌমিকরা (Sovereignty) বলতে রাষ্ট্রের এমন এক ক্ষমতাকে বুঝায় যার উদে
আর কোন ক্ষমতা নাই। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নাম ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাই সার্বভৌমত্ব এ ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র সমস্ত
ব্যক্তি ও ব্যক্তিদের সং প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ভৌমত্বের সংজ্ঞা দিয়ে জাঁ বোনা বলেন, এটি নাগরিক ও প্রজাদের উপর আরোপিত এমন সীমাহীন ক্ষমতা যা আইনের যারা ব্যাক নয়।” অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব এমন এক ক্ষমতা যা আইনের ঊর্ধ্বে। উইলোবি বলেন, “রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ইচ্ছাই সার্বভৌমত্ব অব্যাপক বাসে বলেন, “প্রত্যেক প্রভা ও সংঘের উপর মৌলিক, চরম ও সীমাহীন ক্ষমতাকে সার্বভৌমত্ব বলে। সার্বভৌমত্বের একত্ববাদের সমর্থক মান অধীন সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা নিয়ে বলেন, “যদি কোন সুনির্দিষ্ট মানবীয় কর্তৃপক্ষ অনুরূপ কোন কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগতা প্রকাশে অত্যন্ত না হন বরং সমাজের অধিকাংশ জনগণের নিকট থেকে স্বভাবজাত আনুগতা লাভ করেন তবে সেই নির্দিষ্ট উচ্চ কর্তৃপক্ষ সেই সমাজে সার্বভৌম এবং উক্ত সার্বভৌমকে নিয়ে গঠিত সম হল রাজনৈতিক স্বা উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত স্থায়ী
অবিভাজ্য, অহস্তান্তরযোগ্য এবং সার্বজনীন ক্ষমতা। এ ক্ষমতার বলে বাই তার অধীন সকলকে আদেশ
ও নির্দেশ দান করে এবং সকলের নিকট হতে আনুগত্য লাভ করে।
১০.১.২ সার্বভৌমত্বের ধারণার বিকাশ প্রাচীন কালে রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে আলোচনা করা হলেও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা পরিষ্কারভাবে।
লক্ষ করা যায় না। সার্বভৌমত্বের ধারণা মধ্যযুগে প্রকাশ করে এবং আধুনিক যুগের শুরুতে পরিপূর্ণতা অর্জন করে। মধ্যযুগে ইউরোপে রাজা ও গোপের লড়াইয়ে রাজা জয়ী হলে বণিকগণ তাদের ব্যবসায়ের নিরাপত্তার জন্য বাজার প্রতি আনুগতা নিতে আরম্ভ করে, ফলে রাজার শক্তি বৃদ্ধি হয়। নবজাগরণের ফলে সাম্রাজ্যের পরিবর্তে রাজাদের কর্তৃত্বে বেশ কয়েকটি জাতীয় রাষ্ট্রের সূচনা হয়। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে টিউডর রাজবংশ, স্পেনে পঞ্চম চার্লস এবং ফ্রান্সে চতুর্দশ লুই এর কর্তৃত্বাধীনে চসামে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে এ সময়ে রাষ্ট্র ও সার্বধৌমত্ব সম্পর্কে ধারণা গড়ে র্বভৌমত্ব বলতে শাসক বা রাজার চরম ক্ষমতাকে মনে করা হত। পরবর্তীতে লক এ রুশোর লেখনীতে যথাক্রমে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ও গণসার্বভৌমত্বের ধারণা বিকশিত হয়। আধুনিককালে সার্বভৌমত্ব আর রাজার বা কোন ব্যক্তিরা অসীম ক্ষমতা নয়, বরং এটি জনগণের চরম ক্ষমতা যা রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীনে থেকে সরকারের মাধ্যমে প্রকাশিত ও বাস্তবায়িত হয়।
১০.১.৩ সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে কতকগুলো বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বৈশিষ্ট্যগুলো নি
(১) চরম ও চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব হল চরম ক্ষমতা। কারণ রাষ্ট্রের এ ক্ষমতার উর্ধে আর কোন ক্ষমতা
থাকে না। এ ক্ষমতাবলে বই এর অভ্যন্তরস্থ সকল ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্রের
আদেশ ও নির্দেশ সকলের জন্য অবশ্য পালনীয়। কোন ক্ষমতাই রাষ্ট্রের এই ক্ষমতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। (২) হারী ভৌমত্ব স্থায়ী ক্ষমতা রাষ্ট্র যতদিন থাকবে ততদিন এ ক্ষমতা বহাল থাকবে।
শাসকের পরিবর্তন হলেও সার্বভৌম ক্ষমতার কোন হেরফের হয় না বা কোন পরিবর্তন হয় না।
(৩) অবিভাগ- সার্বভৌমত্ব একক ও অভিন্ন। একে বিভক্ত করে বিভিন্ন হয়ে নাস্ত করা যায় না।
বিভক্ত করলে সার্বভৌমত্বের বিনাশ ঘটে।
(৪) অহস্তান্তরযোগ্য সার্বভৌমত্ব হস্তান্তরযোগ্য নয়। একে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের হস্তান্তরের অর্থ সেই রাষ্ট্রের মৃত্যু হ (৫) সার্বজনীন ও শাশ্বত সার্বভৌম রাষ্ট্রের সর্বব্যাপী ও চিরন্তন ক্ষমতা। রাষ্ট্রের সকল সংস্থা এর
অধীন। এ ক্ষমতা চির অটুট। রাষ্ট্র থাকলে সার্বভৌমত্ব থাকবে। রাষ্ট্রের বিনাশ না হলে এর বিনাশ হয়।
এ
১০.১.৪ সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন রূপ সার্বভৌমত্বকে প্রধানত তিনটি অধ্যানে মোট ছয় ভাগে ভাগ করা হয়। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা:
(ক) অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব- অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব বলতে রাষ্ট্রের সেই ক্ষমতাকে বুঝায়
যা দ্বারা রাষ্ট্র রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্রপ্রণীত আইনের প্রতি এ ক্ষম
বলে রাষ্ট্র আনুগতা আদায় করে। আইন লঙ্গনের জন্য এ ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র চরম সংবিধান করে থাকে।
বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব বলে রাষ্ট্র নিজ কৃত রক্ষা ও অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাধীনভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে। এ
ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ মুক্ত থাকে এবং স্বাধীনভাবে সামরিক, কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক চুক্তি সম্পাদন করতে পারে। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব একই সার্বভৌমত্বের দ্বিমুখী প্রকাশ মাত্র, সার্বভৌমত্বের দুটি ধরন
(খ) নামসর্বস্ব ও কার্যকর সার্বভৌমত্ব যখন সার্বভৌম ক্ষমতা কোন ব্যক্তির নামে পরিচালিত হলেও প্রকৃতপক্ষে তার কোন ानখ তাকে নামসর্বস্ব সার্বভৌমত্ব বলে। যেমন বৃটেনের রাজার নামে সার্বভৌমত্ব থাকলেও রাজা কোন কার্যকর ক্ষমতা প্রয়োগ করেন না। তাই বলা হয়ে থাকে যে, রাজা রাজত্ব করেন শাসন করেন না। এরূপ সার্বভৌমত্বকে নামসর্বস্থ সার্বভৌমত্ব বলা হয়।
অপরপক্ষে বাস্তবে যারা সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটে তাকে কার্যকর সার্বভৌম বলে। যেমন বৃটেনের মন্ত্রীসভা প্রকৃত সার্বভৌম। কেননা বৃটেনের আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত বৃটিশ মন্ত্রীসভার
কোন সিদ্ধান্তকে রাজ করতে পারে (গ) আইনগত ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব- কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে ক্ষমতার প্রতিফলন ঘটলে তাকে আইনগত সার্বভৌমত্ব বলে। আইনের মাধ্যমে যে চরম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে তাই আইনগত সার্বভৌমত্ত্ব। এই আইনের দ্বারা ঘোষিত আদেশ কেউ অমান্য করতে পারে না। বৃটেনের রাজা সমেত পার্লামেন্ট এরূপ সার্বভৌমত্বের উদাহরণ। ইংল্যান্ডে এমন কোন আইন নেই যা পার্লামেন্ট পাস বা বাতিল করতে পারে না এবং এমন কোন কর্তৃপক্ষ নেই যা পার্লামেন্ট প্রণীত আইনকে বলবৎ করতে অস্বীকার করতে পারে।
অপরপক্ষে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব বলতে আইনগত সার্বভৌমত্বের পিছনে অবস্থানকারী সেই কর্তৃপক্ষকে বুঝায় যার কর্তৃত্বকে চূড়ান্ত পর্যায়ে আইনগত সার্বভৌমত্ব আনুগতা দিতে বাধ্য। এটি অশক প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পন্ন জনমত যা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। একে জনগণের সার্বভৌমত্ব বলে যা নির্বাচক মণ্ডলীর মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সেজন্য নির্বাচকমণ্ডলীর ক্ষমতাকে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব বলে। সাধারণভাবে জনমত আকারে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের মাধ্যমে তৈ সার্বভৌমত্বের প্রতিফলন।