আজাদ হিন্দ বাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান । ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান । নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী

আজাদ হিন্দ বাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান । 

ভূমিকা : আজাদ হিন্দ সেনারা দিল্লী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি ঠিকই কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজাদিন বাহিনীর অবদান ভারতের ইতিহাসের পাতায় চিরকাল সোনার অক্ষরে লেখা । আজাদিন বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর তার শেষ নির্দেশনামা ঘোষণা করেছিলেন – পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নেই যা ভারতকে প্রদানত করে রাখতে পারেন । ভারত স্বাধীন হবে এবং তা হবে অনতিকাল এর জন্য ।

আজাদ হিন্দ বাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান : 

সুভাষ চন্দ্রের দেশত্যাগ : সুভাষচন্দ্র বসু  দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ইংরেজরা কোনদিনই ভারতকে স্বাধীনতা দেবে না । তাই দ্বীপ তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৈদেশিক শক্তির সহায়তায় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । এজন্য যুদ্ধ শুরু হলে ভারত্তোলক আইনে গ্রেফতার করে পরে সুভাষচন্দ্র কে কলকাতার এলগিন রোডে তার নিজের ঘরে অন্তরীণ রাখা হয় । ব্রিটিশদের করা প্রবাহ এরিয়া ভাই 25 বছর সাহায্যে মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের ছদ্মবেশে সুভাষচন্দ্র দেশ ত্যাগের জন্য বেরিয়ে পড়ে । ডক্টর অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাকে দেশ নায়ক বলে বরণ করেছিলেন ভাগ্যের পরিহাসে তাকে দেশ ত্যাগ করতে হলো । 

বিদেশের সাহায্য লাভের প্রচেষ্টা :  

১) রাশিয়া : সুভাষচন্দ্র সিন অর অরল্যান্ডো ম্যাক্সওটা ছদ্মনাম নিয়ে কাবুল থেকে বার্লিন যাওয়ার পথে মস্কোতে কিছুদিন অবস্থান করেন । মহাদেশ কয়টি নিরসনে তাদের কাছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন । কিন্তু রুশ রাষ্ট্রপ্রধান  স্টালিনের কাছ থেকে কোনো রকম সহযোগিতার আশ্বাস পাননি । আসলে একসময় রুশ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্ট্যালিন সম্ভাব্য জার্মান আক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে ব্রিটেনের মিত্রতা গড়ে তোলায় অধিক আগ্রহী ছিলেন । আই এন এ এর প্রকাশনা ও প্রচার সচিব এস এ আয়ার বলেছেন কবল থেকে বার্লিনের প্রথম মস্কোয়ে অবস্থানকালে যদি রাশিয়া থেকে কিছুটা আস্বাদিত তবে তিনি কর্মক্ষেত্র হিসেবে মস্কোকেই বেছে নিতেন ।

জার্মানিতে : সুভাষচন্দ্র এরপর বিমানযোগে জার্মানির বার্লিনে এসে পৌঁছান বার্লিনে তিনি গিরিজা মুখার্জি,এম আর ও বাস নাম্বার সহ কুড়ি জন ভারতীয়কে নিয়ে গড়ে তোলেন ফ্রী ইন্ডিয় সেন্টার । পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে গঠন করেন ইন্ডিয়ান লিজিয়ন বা ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মি  । সুভাষচন্দ্র হিটলারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ এর সঙ্গে দেখা করেন ও ভারতীয় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে পরিকল্পনা পেশ করেন । স্থির হয় : 1) বার্লিন থেকে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার চালাবেন 2) জার্মানিতে বন্দি ভারতীয় সেনাদের নিয়ে স্বাধীন ভারতীয় সংঘ গড়ে তুলবেন 3) জার্মানি ভারতকে স্বাধীনতা স্বীকৃতি জানাবে । 4) আফগানিস্তানকে ভারত ও ইউরোপের মধ্যে কার যোগসূত্রের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে । জার্মান সরকার সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পনা অন্যান্য শর্ত গুলি মেনে নিলেও ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হয়নি । 

আরোও পড়ুন :- লোককথার সংজ্ঞা এবং বৈশিষ্ট্য লেখ । লোককথার শ্রেণীবিভাগ ও সংজ্ঞা।লোককথার গুরুত্ব লেখ

3) জাপান :- ইতিমধ্যে এশিয়া সম্পর্কে জাপানের রণনীতির বদল ঘটে । পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে ভারতসহ এশিয়ার মুক্তি সংগ্রামে জাপান সাহায্যের নীতি গ্রহণ করেন । এতে উৎসাহিত হয়ে সুভাষচন্দ্র জাপানের সাহায্যে মুক্তিসংগ্রামের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । সুভাষচন্দ্র জাপানের প্রধানমন্ত্রী মার্শাল তেজোর আমন্ত্রণের জাপান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ।

1) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানি থেকে সমুদ্রপথে সাবমেরিনে করে জাপান আশা ছিল অত্যন্ত বিপদসংকুল । তবুও সুভাষচন্দ্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুঃসাহসিক সাবমেরিন অভিযানে প্রায় কয়েক হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে জাপানের টোকিওতে এসে পৌঁছায় । সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী তেজস সঙ্গে দেখা করলেন জাপানের পার্লামেন্ট ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে সর্বতোভাবে সহায়তা দানের নীতি ঘোষণা করেন । শুরু হয় সুভাষের স্বপ্নের অভিযান । 

2) আই. এন. এ- এর নেতৃত্ব গ্রহণ : ভারতের বিপ্লবীদের জনাব রাজবিহারী বসু লোহার ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সুভাষ এর আগে জাপানে চলে এসেছিল । এখানে তিনি এবং মুক্তি বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন । ব্যাংকক শহরে এক সম্মেলনে রাসবিহারী সভাপতিত্ব গড়ে ওঠে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ । এরপর ক্যাপ্টেন মোহন সিং এর সক্রিয় সহযোগিতায় 25000 ভারতীয় সেনা নিয়ে ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর আজাধীন ফৌজ গঠিত হয় । সুভাষচন্দ্র জাপানের ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ এর দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান । সুভাষচন্দ্র সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় রাজবিহারী বোসএর হাত থেকে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন । 

3) আইএনএ পুনর্গঠন : আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর সুভাষচন্দ্র একে নতুন করে সাজিয়ে তোলেন । আজাদ হিন্দ বাহিনী কে তিনি গান্ধী ব্রিগেড আজাদ ব্রিগেড, নেহুরু ব্রিগেড, প্রভিত্তি  ব্রিগেডে ভাগ করেন । বালক, বালিকাদের  নিয়ে বাল সেনাদল এবং নারীদের নিয়ে ঝাঁসির রানী ব্রিগেড গঠিত হয় । প্রবল অনিচ্ছার সত্বেও  শেষ পর্যন্ত অনুগামীদের অনুরোধে নেতাজি নিজের নামে সুভাষ ব্রিগেড গঠন করে ।  

4) আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা : হাজার 1943 খ্রিস্টাব্দে 21 অক্টোবর নেতাজি আজাদহিন্দ সরকার গঠন করার কথা ঘোষণা করেন  । এই সরকারের বিভিন্ন পদগুলি ছিলেন——-1. আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সমর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুভাষচন্দ্র বসু 2. মহিলা সংঘ ক্যাপ্টেন শ্রীমতি লক্ষ্মী স্বামীনাথন 3. প্রকাশনা ও প্রচার : এস. আয়ার । 4. অর্থ:-  লে কর্নেল এ. সি চ্যাটার্জী । 5. সচিব : এ .এস সহায়  6. সর্বোচ্চ উপদেষ্টা: রাসবিহারী বসু 7. আইন উপদেষ্টা: এ এন সরকার । 

 5) সরকারের লক্ষ্য: নেতাজি ঘোষণা করেন আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো ভারতের ব্রিটিশ শাসনের উৎখাত করা । এই সরকারের রাষ্ট্রভাষা ছিল হিন্দুস্তানি । জাতীয় পতাকা ছিল কংগ্রেসের তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলনকারী বাঘের ছবি । জাতীয় সংগীত ছিল রবীন্দ্রনাথের জনগণমানো এবং জয়হিন্দ হলো পরস্পরের প্রতি সম্ভাষণ বাক্য । স্বাধীন আজাদ হীন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল থাইল্যান্ড, ইতালি,জার্মানি জাপান, ক্রোয়েশিয়া , বার্মা , কুয়ামিন ,চীন, ফিলিপিনস মাঞ্চুরিয়া প্রভিত্তি বিশ্বের ৯য়টি দেশ । আজাদ হিন্দ বাহিনী তাদের সংগ্রামের কথা প্রকাশ করার জন্য সিঙ্গাপুর প্রেরন ব্যাংকক থেকে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় তার প্রচার শুরু করে এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন । জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজো 6 নভেম্বর 1943 খ্রিস্টাব্দে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দুটি আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেয় । নেতাজি 31 ডিসেম্বর 2 দ্বীপের নাম শহীদ ও স্বরাজ । এরপর আজাদিন সরকার বৃটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । 

3) ভারত অভিযান : 23 অক্টোবর 1943 খ্রিস্টাব্দে আজাদিন সরকার ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বৃটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । নেতাজি রেঙ্গুন এ প্রধান সামরিক দপ্তর গড়ে তোলেন ও শুরু করেন তার বহু কাঙ্ক্ষিত ভারত অভিযান । বিরাজা দিন সেনারা তাই ফোন থেকে যাত্রা শুরু করে পাহাড়-পর্বত নদীকে প্রায় 400 মাইল পথ পায়ে হেঁটে ভারত সীমান্তের দিকে পাড়ি দেন । কক্সবাজার থেকে 50 মাইল দূরে মৌদোক নামক স্থানে ব্রিটিশ গাড়ি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায় আজাদ হিন্দ সেনারা । ক্যাপ্টেন সুরাজমল এর নেতৃত্বে আজাধীন সেনারা মৌডোক জয় করে । অবশেষে কোহিমা পর্যন্ত এসে ভারতের মাটিতে তেরেঙ্গা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ( 6 এপ্রিল 1944 খ্রিস্টাব্দে ) 

আত্মসমৰ্পণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে মিত্রশক্তির কাছে অক্ষশক্তির পরাজয় ঘটতে থাকলে জাপান সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেয়। আমেরিকা বিপুল শক্তি নিয়ে জাপানের দিকে এগিয়ে এলে কোণঠাসা জাপানি সেনা ও বিমানবাহিনী স্বদেশ রক্ষার্থে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে রওনা হয়। জাপানের প্রত্যাবর্তন ও সামরিক বিপর্যয়ে আজাদ হিন্দ সেনাদের মনোবল ভেঙে যায়। খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভারতীয় বাহিনীকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোহিমা ছেড়ে প্রবল বর্ষণ ও একহাঁটু কাদার মধ্য দিয়ে কয়েকশত মাইল পিছিয়ে যেতে হয়। অবশেষে জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে (আগস্ট, ১৯৪৫ খ্রি.) জাপানিদের দ্বারা অস্ত্র ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। খাদ্যাভাব, প্রবল শীত, ম্যালেরিয়া, পার্বত্য অঞ্চলের বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড় প্রভৃতি কারণে কয়েক হাজার আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনার মৃত্যু হয়। ফলে আজাদ হিন্দ সেনারা অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় ভেঙে না পড়ে দু-চোখে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) থেকে সায়গন-এ পৌঁছোন। সীমাহীন আশাবাদী নেতাজি বলেন, “আমরা অন্ধকারতম মুহূর্ত। অতিক্রম করেছি, সূর্যোদয়ের আর দেরি নেই, ভারত স্বাধীন হবেই।” বলা হয় যে, ফরমোজার কাছে তাইহোকুতে এক বিমান দুর্ঘটনায় (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৮ আগস্ট) তাঁর মৃত্যু হয়—যদিও এই ঘটনার সত্যতা আজও সংশয়াতীত নয়।

Leave a Comment