Help Bangla

Blogs in Bangali

জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচারবাদ কী? মতবাদটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা কর।

জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচারবাদ কী? মতবাদটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা কর। 

জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচারবাদ কী

প্রকৃতি ও পরিধি সংশ্লিষ্ট দর্শনের শাখা। জ্ঞানতাত্ত্বিক অভিযাত্রা মূলত ‘জ্ঞান কি’ এবং ‘কিভাবে এটি অর্জিত হতে পারে’- এ-প্রশ্নগুলো নিয়েই। যেকোনো বিষয় বা সত্তা সম্পর্কে কী মাত্রায় জ্ঞান অর্জন করা যায়- এটা নিয়েও আলোচনা চলে। জ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতির দার্শনিক বিশ্লেষণ এবং এটি (জ্ঞানের স্বরূপ) কিভাবে সত্য, বিশ্বাস ও যাচাইকরণ ধারণার সাথে সম্পর্কিত- বেশিরভাগ বিতর্ক এটাকে কেন্দ্র করেই। গ্রিক “epistēmē” ও “logos” শব্দদ্বয়ের সংসক্তিতেই Epistemology শব্দটির উদ্ভব আর এই শব্দেরই বাংলা রূপ, জ্ঞানতত্ত্ব। স্কতিশ দার্শনিক জেমস ফেদারিক ফেরিয়ারের (James Frederick Ferrier) মাধ্যমে Epistemology শব্দটি আলোচনায় এসেছে।

সাধারণত জ্ঞানতত্ত্ব বা জ্ঞানবিদ্যায় জ্ঞানের যে ধরন সচরাচর আলোচনা করা হয় তা বাচনিক জ্ঞান(propositional knowledge), যে ‘জ্ঞান যা’ (knowledge that) হিসেবেও পরিচিত। এটা ‘জ্ঞান কিভাবে’ (knowledge how) ও ‘পরিচয়-জ্ঞান’ (acquaintance-knowledge)এর চেয়ে পৃথক। কিছু দার্শনিক ভাবেন যে, জ্ঞানতত্ত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট ‘জ্ঞান যা’, ‘জ্ঞান কিভাবে’ ও ‘পরিচয়-জ্ঞান’এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল তার পেপার On Denoting ও পরের বই Problems of Philosophy-এ “knowledge by description” ও “knowledge by acquaintance” এর মধ্যকার পার্থক্যে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেন। গিলবার্ত রাইলও The Concept of Mind বইয়ে উদ্বিগ্নতার সাথে knowing how ও knowing that –এর মধ্যকার পার্থক্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। মিখাইল পোলানঈ (Michael Polanyi) তার Personal Knowledge বইয়ে knowing how ও knowing that-এর জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রাসঙ্গিকতার পক্ষে যুক্তি পেশ করেছেন। বাইসাইকেল চালনার সময়ে ভারসাম্য রক্ষার উদাহরণ দিয়ে তিনি প্রস্তাব রাখেন যে, ভারসাম্য রক্ষা করা সম্পর্কে পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক জ্ঞান কিভাবে তা চালানো যায় তার বাস্তব জ্ঞানের পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। কিভাবে উভয়কে প্রতিষ্ঠিত ও ভিত্তিশীল করা যায়, তাও তিনি প্রস্তাব করেন। এ-অবস্থায় রাইল যুক্তি দেন যে, knowledge that ও knowledge how-এর পার্থক্য স্বীকার করার অসামর্থ্যই অসীম পূর্বগতিকে (infinite regress) প্রণোদিত করে

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু জ্ঞানতাত্ত্বিক, যেমন- সোসা (Sosa), গ্রেকো (Greco), ভানভিগ (Kvanvig), জাগজেবস্কি (Zagzebski) ও ডান্কান প্রিটচার্ড (Duncan Pritchard) যুক্তি দেন যে, জ্ঞানতত্ত্ব কেবল প্রস্তাবনা বা প্রস্তাবিত-মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়-আশয় নয়, জনগণের ‌‘বিষয়-আশয়’ (properties), বিশেষ করে বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যের (intellectual virtues) মূল্যায়ন করবে।

যে মত অনুসারে ইন্দ্রিয়ানুভব ও বুদ্ধি উভয় জ্ঞান লাভের উৎস, সেই মতবাদ বিচারবাদ নামে পরিচিত। এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়াল কান্ট। তিনি অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদের সমালোচনা করেন এবং উভয় মতবাদের ত্রুটি নির্দেশ করে। এই মতবাদ দুটির সামঞ্জসা করেন এবং তিনি এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচারবাদ মতবাদটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা কর

জ্ঞান উৎপত্তিতে বুদ্ধিবাদীদের মতবাদ হল–যথার্থ জ্ঞান লাভের একমাত্র উৎস হল বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা। অপরদিকে, অভিজ্ঞতাবাদীদের মতবাদ হল বাহ্যিক জগতের জ্ঞান লাভের একমাত্র উৎস হল ইন্দ্রিয়ানুভব। অর্থাৎ জ্ঞানের পরিধি ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

কান্ট তাঁর “Critique of Pure Reason’ গ্রন্থে জ্ঞান উৎপত্তি সম্বন্ধে বিচারবাদ আলোচনা করেছেন। জ্ঞানের উৎস সম্বন্ধে বিচার বিশ্লেষন করে কান্ট। এই সিদ্ধান্ত করে যে, অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদ উভয় মতবাদ আংশিক ত্রুটিপূর্ণ ও আংশিক সত্য । কেননা, বুদ্ধিবাদ অভিজ্ঞতাবাদকে উপেক্ষা করে বুদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। একইভাবে, অভিজ্ঞতাবাদ বুদ্ধিবাদকে উপেক্ষা করে ইন্দ্রিয়ানুভবের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। তাই, তিনি বলেন যে শুধুমাত্র স্বতঃসিদ্ধ অন্তর ধারনা থেকে অবরোহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নিঃসৃত হলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে নূতনত্ব থাকে না। আবার কেবল অভিজ্ঞতার সাহায্যে প্রাপ্ত জ্ঞান সর্বজনগ্রাহ্য হয় না। কেননা সংবেদনের সাহায্যে আমরা যা পাই তা কেবল আকারবিহীন উপাদান, যা শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়ানুভব দিয়ে অভিজ্ঞতার সাহায্যে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। অভিজ্ঞতার জন্য বৌদ্ধিক আকারের প্রয়োজন। সুতরাং জ্ঞান লাভের একমাত্র উৎসরূপে কোন একটি মতবাদকে গ্রহন করলে চলবে না। কেননা সেই জ্ঞান অসম্পূর্ন হয়ে যাবে। তাই এই দুটি মতবাদের ত্রুটি বিচার, বিশ্লেষণ করে কান্ট দুটি মতবাদের সমন্বয় করেছেন। ফলে সেই জ্ঞান হবে সার্বিক ও আবশ্যিক এবং নূতনত্ব। জ্ঞান ইন্দ্রিয়ানুভবের সাহায্যে নূতনত্ব এবংবুদ্ধির সাহায্যে সার্বিক ও আবশ্যিক হয় দেখান যে জ্ঞান উৎপত্তি ক্ষেত্রে কোন একটা মতবাদকেই গ্রহন না করে অভিজ্ঞতাবাদ ও বুদ্ধিবাদ উভয় মতবাদের প্রয়োজন আছে। । সুতরাং কাস্ট

কান্ট বিষয়টিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, জ্ঞানের দুটি দিক আছে, একটি উপাদান এবং অপরটি হল আকার। সংবেদনের মাধ্যমে আমরা যা পাই তা জ্ঞানের উপাদান মাত্র। বুদ্ধির সাহায্যে পাই তা হল- আকার। আমাদের বোধ শক্তি উপাদানের উপর তার আকার বা ধারনা প্রয়োগ করে, উপাদানকে আকারিত করে, ফলে উপাদান অর্থপূর্ণ হয়। এই বিষয়ে কান্ট বলেন – উপাদানবিহীন শুধু জ্ঞান শূন্যগর্ভ এবং জ্ঞানের আকার ব্যাতিত শুধু উপাদান অন্ধ।

কাস্ট জ্ঞান ক্রিয়ার দুটি দিকের উল্লেখ করেন।। – একটি সংবেদনী শক্তি এবং অপরটি হল বুদ্ধিশক্তি । আবার সংবেদনী শক্তির দু আকার দেশ ও কাল। দেশ ও কালকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পাওয়া যায় না। কেননা দেশ ও কাল অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ বা অভিজ্ঞতা পূর্বশর্ত। দেশ ও কাল শুদ্ধ অনুভুতির দ্বারা জানা যায়। বহিস্থ উৎসস্থল থেকে আগত বিচ্ছিন্ন সংবেদন রাশিকে সংবেদনী শক্তির দু আকার দেশ ও কালের আকারে আকারিত করে। দেশ ও কালের আকারে আকারিত সংবেদন রাশিকে আমাদের মনো জগতে উপস্থিত করে। কিন্তু অসংবদ্ধ সংবেদনরাশিকে সংবেদনশক্তি দেশ ও কালের আকারে সম্বন্ধ করলে জ্ঞান সম্পূর্ন হয় না। সংবেদনের বিষয়টি যে একটি দ্রব্য যা শুনের মাধ্যমে প্রকাশ পায় সেটা যে কোন না কোন একটি অস্থিত্বশীল পদার্থ –এসব বোধের প্রয়োজন হয়। তাই ওই সংবেদনের বিষয়টি একটি অর্থপূর্ণ করতে গেলে বুদ্ধিশক্তির প্রয়োজন হয়।কান্টের মতে, বুদ্ধিশক্তির বারটি (১২) প্রতায় আছে। এসব প্রকার অভিজ্ঞতালব্ধ প্রতিটি বস্তু জ্ঞানের ক্ষেত্রেই এদের প্রয়োগ করতে হয়। দ্রব্য গুন, পরিমান কারনতা একত্ব বহুত্ব প্রভৃতি প্রত্যয়গুলিকে দেশ ও কালের আকারে আকারিত সংবেদন রাশির উপর একে একে প্রয়োগ করা হয়। আমরা একটি বিষয়ের সুনিশ্চিত আন লাভ করি।

কিন্তু এভাবে যে আমরা জ্ঞান লাভ করি তা কান্ট তাকে স্বয়ংসদবস্তুর জগৎ বলেন না। কেননা তা স্বয়ংসদবস্তুর অবভাগের জগৎ। স্বয়ংসদবস্তুর জগৎকে জানতে হলে তার থেকে সৃষ্ট সংবেদন রাশিকে অবিকৃতরূপে জানতে হবে। কিন্তু আমাদের মন এর গঠন এমনই যে, যে ইন্দ্রিয় পথ দিয়ে যেসব সংবেদন রাশি আমাদের মনে আসে, তাদের মনে আকার ও প্রকার মন্ডিত না করে। আমরা জানতে পারি না। মানসিক উত্তেজনার কারণস্বরূপ বস্তুজগৎ অস্থিত্বশীল হলেও মনে আকার ও প্রকারে মন্ডিত করে যে জগৎ আমরা জানি তা আমাদের মনের রচনা আর বাহা জগৎ অবভাস। সেইজনা, কান্ট বলেন বাহ্য বস্তু থাকলেও তা আমাদের কাছে চিরদিন অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় থেকে যায়।

অধ্যাপক হসপার্স কান্টের এই ব্যাখ্যাকে অতি সুন্দর উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন। উপমাটি হল ধরাযাক, যদি কেউ সব সময় সবুজ চশমা পড়ে থাকে তাহলে সে জগতের সবকেই সবুজ দেখবে তার ঐ সবুজ চশমার জন্য। এই পরিস্থিতিতে তার ধারণা হবে সে জগতের সব কিছুই সবুজ দেখছে। এখানে জগতের সকল বিষয়ই সবুজ বা সবুজ আভাযুক্ত । –এইরূপের জ্ঞানটি সবুজ চশমা পড়া লোকটির কাছে পূর্বতঃসিদ্ধ সংশ্লেষক জ্ঞান। এই জ্ঞানটি পূর্বতঃসিদ্ধ কেননা এ রঙ্গিন বৈশিষ্ট্যের চশমার জন্য লোকটি যা দেখবে তা অনিবার্য হবে। আর জ্ঞানটি অভিজ্ঞতা নির্ভর হওয়ায় তা সংশ্লেষক কেননা বস্তুর ধারণা বিশ্লেষণ করলে লালের ধারণা পাওয়া যাবে না। সুতরাং আমাদের মনে যে দেশ ও কাল নামক দুটি রঙ্গিন চশমা সেঁটে আছে, তা জগতের সব কিছুই দৈশিক বিস্তার ও কাণিক পর্যায়ে অনুভূত হয়। সুতরাং দেশ ও কালের মাধ্যমে আমাদের বাহা জগতের বা প্রতিভাসিত জগতের অনুভূত হয় কিন্তু দেশ ও কালের বাইরে অর্থাৎ অতিরিক্ত বাহাস জগতের অনুভূত হয় না কেননা জগতের আসল স্বরূপ দেশ ও কালে আকারে আকারিত হয় না । তাই সবস্তু বা জগতের আসল স্বরূপ আমাদের কাছে অজ্ঞাত ও তায়ে থেকে যায়।

কাস্টের এই জ্ঞানতাত্তিক মতবাদ দর্শনের ইতিহাসে এক বিপ্লবের সৃষ্ট করেছে। কান্টের পূর্বসূরি দার্শনিকের অভিমত হল- জ্ঞানের ক্ষেত্রে মন নিক্রিয় থাকে এবং সত্যজ্ঞানের ক্ষেত্রে মনের ধারনা বিষয়ের অনুরূপ হয়। কিন্তু কান্ট ঠিক তার বিপরীত মত পোষন করেন। জ্ঞানের ক্ষেত্রে

মনের ধারনা বিষয়ের অনুরূপ হওয়ার পরিবর্তে বিষয় আমাদের মনের আকার ও প্রকার দ্বারা

মন্ডিত হয়, যা জ্ঞানের জগতে নিঃসন্দেহে এ এক অভিনব ও বৈপ্লবিক মতবাদ।

Updated: July 23, 2022 — 4:47 am

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Help Bangla © 2023 Frontier Theme