ভারতের অনুসৃত জোট নিরপেক্ষতার নীতি বিশ্লেষণ কর

ভারতের অনুসৃত জোট নিরপেক্ষতার নীতি বিশ্লেষণ কর।

জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন (Non-aligned Movement )

বিশ্বের শতাধিক রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্বব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক নতুন যোগাযোগ সম্পর্কিত ব্যবস্থা। বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশবাদের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব ও ঠাণ্ডা যুদ্ধজনিত সমস্যাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন প্রসারিত হয়েছে। বিগত তিন দশকে এই আন্দোলনের প্রকৃতিগত পরিবর্তন। হয়েছে। প্রথমে, মূলতঃ রাজনৈতিক আন্দোলনরূপে শুরু হলেও পরবর্তীকালে, তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনকে একাধারে বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তনের প্রতিফলন ও প্রত্যুত্তর বলে বর্ণনা করা যায়।

জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রথম সূচনা সম্পর্কে দু’টি মতবাদ আছে। প্রথম ব্যাখ্যা অনুযায়ী, 1950-এর মাঝামাঝি আন্দোলনের সূচনা হয় ও ঐ ব্যাখ্যা নেহরু, নাসের ও টিটোর মধ্যে কুটনৈতিক আলোচনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা অনুসারে, 1961 সালের বেলগ্রেড শীর্ষ সম্মেলনকে আন্দোলনের সূচনা হিসাবে ধরা হয়। পিটার লায়নের মতে, বেলগ্রেড শীর্ষ সম্মেলনের প্রাথমিক প্রস্তুতি থেকে দেখা যায় যে, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা তার আগেই হয়েছিল। তাঁর মতে, লুসাকা শীর্ষ সম্মেলনের (1970) আগে পর্যন্ত জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন শব্দগুলি ধারাবাহিকতা ও উদ্দেশ্যমূলক গতিপথের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত তাৎপর্য লাভ করেনি।

জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির প্রতিনিধিদের প্রস্তুতিমূলক আলোচনা শুরু হয় 1961 সালের জুনে কায়রোতে ও সেখানেই সম্মেলনে সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলিকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য কতকগুলি শর্ত নির্দিষ্ট করা হয়। ঐসব নিয়মের মধ্য দিয়ে জোট-নিরপেক্ষতার প্রথম কার্যকরী সংজ্ঞা পাওয়া যায়। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য নিম্নলিখিত শর্ত নির্দিষ্ট করা হয়— সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা সমন্বিত রাষ্ট্রগুলির সহাবস্থানের ভিত্তিতে

স্বাধীন নীতি গ্রহণ করবে বা সেই নীতির প্রতি সমর্থন জানাবে।

। অংশগ্রহণকরী রাষ্ট্র জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সর্বদা সমর্থন করবে।

। অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র বৃহৎ শক্তিবর্গের বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদিত কোন বহুপাক্ষিক সামরিক জোটের সদস্য হতে পারবে না। । যদি কোন রাষ্ট্র কোন বৃহৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ থাকে তবে সেই চুক্তি যেন

ইচ্ছাকৃতভাবে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদিত না হয়। । যদি অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র কোন বিদেশী শক্তিকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেয়, তবে ঐরূপ সুবিধা যেন বৃহৎ শক্তিবর্গের বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে দান করা না হয় ।

ঠাণ্ডা যুদ্ধের অন্তর্নিহিত আপাতবিরোধিতার ফলেই একদিকে দ্বিমেরুকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে বহুমেরুকেন্দ্রিকতার উদ্ভব হয় ও অন্যদিকে জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন প্রসারিত হয়। তবে একথা মনে করা ভুল যে, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রসারের উপর ঠাণ্ডা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। যদি 1956 সালকে বহু শক্তি কেন্দ্রের উদ্ভবের স্পট 1962 সালকে ঠাণ্ডা যুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস ও দাতাতের সূচনাকাল বলে ধরা হয় তবে এটা আন্দোলন বহু শক্তিকেন্দ্রিক পৃথিবীতেই প্রসার লাভ করেছে। জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন আবির্ভাবের মূল কার সাম্রাজ্যবাদের বিনাশ। জোট-নিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার নতুন সার্বভৌম স্বাধীন দেশগুলির যুদ্ধে ও দুই অতি বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়ার অনিচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে। জোট-নিরপেক্ষ স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলির স্বাধীন মানবতার ঘোষণা। জোট-নিরপেক্ষতার আদর্শ প্রথম থেকেই বিরোধী। প্রতিটি জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের ও প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে সেই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি হয়েছে। জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির ভোটদানের প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তারা সাম্র সঙ্গে সংযুক্ত সমস্যা বিষয়ে সংঘবদ্ধভাবে ভোট দিয়েছে। কিন্তু অনেক আধালিক স্থানীয় সমস্যার ক্ষেত্রে জোট নিরপে দেশগুলির মধ্যে বিভেদ ফুটে উঠেছে। শ্রী পি. রত্নম মন্তব্য করেছেন যে, রাষ্ট্রসংঙ্গে জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির ভোটদানের প্রকৃতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে জোট-নিরপেক্ষতার অর্থ হল নেতিবাচক) কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে এর অর্থ পশ্চিমী রাষ্ট্র-ঘেঁষা নীতি অনুসরণ ও কয়েকটি ক্ষেত্রে জোট-নিরপেক্ষতার হা সোভিয়েত-মুখী নীতি গ্রহণ।

বেলগ্রেড শীর্ষ সম্মেলन, 1961

বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত প্রথম শীর্ষ সম্মেলনে যে 25টি রাষ্ট্র উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া ও উত্তর অধিকার রাষ্ট্রগুলির সংখ্যাধিক্য ছিল। এই সম্মেলনের আলোচনায় ইউরোপীয়ান বিষয়গুলি প্রাধান্য লাভ করেছিল। নামলাম। অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা ঠাণ্ডা যুদ্ধ ও সামরিক জোটের উপস্থিতি ও চাপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল এবং উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। সম্মেলনের আলোচনায় সামরিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি প্রাধান্য লাভ করেছিল।

কায়রো শীর্ষ সম্মেলন, 1964

1964 সালে কায়রোতে দ্বিতীয় জোট-নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবিদ্বেষমূলক নীতি ও বিদেশী সামরিক ঘাঁটির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আলোচনার সময় অনেক নতুন সমস্যা, যেমন—আণবিক অস্ত্রমুক্ত এলাকা ও আণবিক অস্ত্রের প্রসার রোধ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা হয়। কায়রো সম্মেলনে রাজনৈতিক বিষয়গুলি প্রাধান্য লাভ করেছিল।

লুসাকা শীর্ষ সম্মেলন, 1970

লুসাকা শীর্ষ সম্মেলন জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন পদক্ষেপের সূচনা করে। সম্মেলনে কেনেন কুয়ান্ডার নেতৃত্বে স্থির করা হয় যে, জোট-নিরপেক্ষ শীর্ষ কূটনীতি নিয়মিতভাবে পরিচালনা করা হবে। সম্মেলনে হিব হয় যে,

তিন বৎসর অন্তর নিয়মিতভাবে জোট-নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করা হবে। সদ্য সমাপ্ত শীর্ষ সম্মেলনের সভাপতি জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির মুখ্য মুখপাত্র রূপে সম্মেলনের

কার্য পরিচালনা করবেন। সম্মেলনে ও দুই সম্মেলনের মধ্যবর্তী সময়ে সভাপতি অন্যান্য ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এই সম্মেলনে

একটি Co-ordinating Bureau প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সম্মেলনে বর্ণবিদ্বেষমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, জিম্বাবোয়ে, ইন্দোচীন মধ্যপ্রাচ্য, নামিবিয়া, সাইপ্রাস ও লেবানন সমস্যা বিষয়ে বিশেষ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ সম্মেলনে বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা সম্বন্ধে জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির সচেতনতার প্রকাশ দেখা যায়। সম্মেলনে এক প্রস্তাবের মাধ্যমে রাষ্ট্রসংঘের কাছে বিশ্ব অর্থব্যবস্থার সংস্কার বিশেষতঃ

189

রাশি, অর্থ, প্রযুক্তি বিনিময় প্রভৃতি বিষয়ে সংস্কারসাধনের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রসংঘের

কাছে আবেদন জানানো হয়। প্রতিনিধিরা সমগ্র বিশ্বের মঙ্গলের জন্য বিশ্বের অর্থনৈতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের

দাবি জানান।

আলজিয়ার্স সম্মেলন, 1973 1973

দৃষ্টিভঙ্গী দান করেছিল। সম্মেলনে ভারত মহাসাগরকে শাস্তির এলাকা রূপে চিহ্নিত করা সম্পর্কিত রাষ্ট্রসংঘের স্বাগত জানানো হয়। সম্মেলনে প্রতিনিধিরা তীব্রভাবে ভিয়েতনাম ও কাম্বোডিয়াতে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ও ল্যাটিন আমেরিকায় নয়া উপনিবেশবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেন। সম্মেলনে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষাকে একটি কার্যসূচি গ্রহণ করা হয় ও জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলির সঙ্গে পশ্চিমের উন্নত দেশগুলি ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

কলম্বো শীর্ষ সম্মেলন, 1976

1976 সালে কলম্বো শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের আলোচনায় অর্থনৈতিক বিষয়ের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। আগের সব জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনে রাষ্ট্রসংঘের প্রতি আস্থা স্থাপন করা হয়। কিন্তু কলম্বো শীর্ষ সম্মেলনে রাষ্ট্রসংঘের সনদের আমূল সংশোধনের দাবি জানানো হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সব উন্নয়নশীল দেশগুলি বিশ্ব-অর্থনীতির সংস্কারের দাবি জানায়। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে ঐক্যবদ্ধন গড়ে তুলেছিল।

হাভানা সম্মেলন, 1979

1978 1979 সালে জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের সাধারণ নীতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিতর্ক দেখা যায়। হাভানা শীর্ষ সম্মেলনে তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে আদর্শগত টানাপোড়েন (tug of war) দেখা যায়। কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো রাশিয়াকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের স্বাভাবিক মিত্র রূপে ঘোষণা করতে উদ্যত হন। অনেক সদস্যই ঐ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের একমাত্র জীবিত প্রতিষ্ঠাতা মার্শাল টিটো জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনকে সোভিয়েতমুখী করার প্রচেষ্টাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেন। তিনি জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনে বিদেশী প্রভাব প্রতিরোধের জন্য আহ্বান জানান। কিউবার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রে জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের নীতি, উদ্দেশ্য এবং সদস্যপদ গ্রহণের নিয়ম ও শর্ত ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনের আলোচনায় দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবোয়ে, পশ্চিম এশিয়া ও সদস্যদের অর্থনৈতিক সমস্যা প্রাধান্য লাভ করে।

নতুন দিল্লী সম্মেলন, 1983

নতুন দিল্লীতে জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের সপ্তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে পশ্চিমী দেশগুলির কাছে নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ও বিশ্বের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য আবেদন জানানো হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সদস্যরা আণবিক শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলির কাছে আণবিক যুদ্ধ প্রতিরোধের দাবি জানায়। সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি, যেমন- ঋণভার, উন্নয়নমূলক সাহায্য, বাণিজ্য, শক্তি, খাদ্য, কৃষি প্রভৃতি প্রাধান্য লাভ করে।

অষ্টম জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলন, হারারে সম্মেলন, 1986 সম্মেলনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন- দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী সরকারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ,

Leave a Comment