সংস্কৃত সাহিত্যে ঐতিহাসিক কাব্যের প্রসঙ্গিকতা
উত্তর : বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্’— রসাত্মক বাক্যই কাব্য। কাব্য দু’প্রকারের শ্রব্যকাব্য ও দৃশ্যকাব্য। যে কাব্যে দৃশ্যতা বা অভিনেয়তা থাকে তাই দৃশ্য কাব্য আর যে কাব্যে রসাস্বাদন কাব্য পাঠ বা শ্রবণের মাধ্যমে হয় তাই শ্ৰব্য কাব্য। শ্ৰব্য কাব্য আবার তিন ভাগে বিভক্ত-পদ্য, গদ্য ও মিশ্র বা চম্পু।
আলঙ্কারিক দণ্ডী গদ্যের সংজ্ঞায় বলেছেন— ‘অপাদঃ পদসন্তানো গদ্যম্’– পূর্বাপর চরণে ছন্দের বন্ধন বর্জিত কাব্য গদ্য কাব্য। দর্পণকার বিশ্বনাথ কবিরাজ অনুরূপভাবে তার সাহিত্য দর্পণে গদ্যের সংজ্ঞায় বলেছেন— “বৃত্তবদ্ধোতিং গদ্যম্’—ছন্দের বা বৃত্তের বন্ধন যাতে থাকবে না তাই গদ্য কাব্য ।
শুধুমাত্র সংস্কৃত সাহিত্যেই নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে গদ্য অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন কালের সাহিত্যরূপে পরিগণিত। বিশ্বের প্রথম লিখিত সাহিত্য ঋগবেদ পদ্যে রচিত। ব্রাক্ষ্মণ, আরণ্যক, তারও পূর্বে কৃষ্ণযজুর্বেদে গদ্যের কিছু বিচ্ছিন্ন নমুনা থাকলেও বৈদিক সাহিত্য মূলতঃ গদ্যের পরিবর্তে পদ্যকেই মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছে। ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের যুগেও পদ্য ভাগেরই প্রাধান্য। ইংরেজী সাহিত্যেও অবস্থাটা অনুরূপ। বাইবেলের ওল্ডটেস্টাম্যান পদ্যেই নিবদ্ধ।
কৃষ্ণ যজুর্বেদ সর্বপ্রথম গদ্যের প্রয়োগ করে। ব্রাক্ষ্মণ ও আরণ্যক ভাগে, উপনিষদের কিয়ৎ অংশে, নাটকের সংলাপে, পতঞ্জলির মহাভাষ্যে, ন্যায় সূত্রের ভাষ্যে, আচার্য শঙ্করের ব্রহ্মসূত্রে এবং তার ভাষ্যে, মীমাংসা সূত্রের শবরভাষ্যে গদ্য ব্যবহৃত হলেও সেগুলো কোন ভাবেই সাহিত্যিক মর্যাদায় অভিষিক্ত নয়। গদ্য সাহিত্যের অপ্রতুলতা ও অর্বাচীনতার প্রকৃত কারণ কি? এর কোন সদুত্তর অলঙ্কারশাস্ত্রে নেই। আলঙ্কারিকগণ ‘গদ্যং কবীনাং নিকষং বদন্তি’ – গদ্য কবি সাহিত্যিকদের পক্ষে কষ্টিপাথর— এযুক্তি – দেখালেও এর সত্যতা কোথাও সমর্থিত হয় নি। সংস্কৃত সাহিত্যে পদ্য ভাগের তুলনায় গদ্য ভাগ যেমনি অপ্রতুল, তেমনি অর্বাচীন।
খ্রীঃ সপ্তম শতকের পূর্বে পরিপূর্ণ গদ্য সাহিত্যের কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। সুবন্ধু, বাণভট্ট ও দণ্ডী, এই তিন কবিকে গদ্য সাহিত্যের পথিকৃৎ হিসেবে পাওয়া যায়।
কালিদাসের পূর্বে পদা কাব্যে অশ্বঘোষের রচনা, দৃশ্যকাব্যে ভাসের নাটকচক্র পাওয়া গেলেও গদ্য কাব্যে দণ্ডী-সুবন্ধু- বাণভট্টের পথিকৃৎ কারা তার কোন নিদর্শন নেই। বৈয়াকরণ কাত্যায়ন তাঁর বার্তিকে আখ্যায়িকার উল্লেখ করেছেন। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি বাসবদত্তা, সুমনোগুরা, ভৈমরথী নামক তিনখানি গদ্য কাব্যের উল্লেখ করেছেন। বররুচি, চারুমতী নামক গদ্যকাব্যের কথা বলেছেন। শৃঙ্গার প্রকাশে আলঙ্কারিক ভোজ চারুমতী ছাড়াও ‘মনোবর্তী’ ও ‘সাতকর্ণী হরণ’ নামক দুখানি গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। অবন্তীসুন্দরী কথাতে কবি দণ্ডী ‘মনোবতী’ কাব্যের প্রশংসা করেছেন—
‘ধবলপ্রভবা রাগ; সা তনোতি মনোবতী’।
কাশ্মীরী কবি জহন তাঁর ‘সৃক্তি মুক্তাবলীতে’ কবি সোমিল এর ‘শূদ্রক কথা’, শ্রী
পলিতের ‘তরাবতী’ নামক দুখানি জনপ্রিয় গদ্যকাব্যের উল্লেখ করেছেন
“তৌ শূদ্রককথাকারোঁ রম্যৌ রামিল- সোমিলোঁ। কাব্যং যয়োদ্বয়োরাসীদর্ধনারীশ্বরোপমৌ।।’
ধনপালের তিলকমারীতে ভট্টার হরিচন্দ্রের গদ্যবশ্বেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু এই উল্লিখিত গ্রন্থগুলি শুধু নামে পর্যবসিত। পরবর্তীকালের হাতে এগুলির কোন নিদর্শন পৌঁছায়নি। জল্হন তাঁর গ্রন্থে শীলা ভট্টারিকা নামক একজন মহিলা গদ্য কবিরও উল্লেখ করেছেন। পাঞ্চালীরীতির পরিচয় দিতে গিয়ে জল্হণ বাণভট্টের পাশাপাশি শীলাভটারিকারও উল্লেখ করেছেন—
“শব্দার্থয়োঃ সমো গুল্কো পাঞ্চালীরীতিরিষ্যতে। শীলাভট্টারিকাবাচি বাণোত্তিষু চ সা যদি।।’
সুবন্ধু ঃ— যে কবি সংস্কৃত গদ্য সাহিত্যের ভাণ্ডারকে পূর্ণতার পথে নিয়ে গেছেন তিনি মহাকবি সুবন্ধু। তাঁর রচিত গদ্যকাব্য বাসবদত্তা। সংস্কৃত কাব্য রসিকদের কাছে বাসবদত্তা এক সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। বাণভট্ট, তাঁর হর্ষচরিতে পূর্বসূরীর কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বলেছেন— ‘কবীনামগলদ্দৰ্পো নূনং বাসবদত্তয়া। বাণভট্ট তাঁর কথাকাব্য কাদম্বরীকে ‘অতিদ্বয়ী কথা’ বলে উল্লেখ করেছেন। সমালোচকগণ মনে করেন এই কথাদ্বয় হল গুণাত্যের বৃহৎকথা ও সুবন্ধুর বাসবদত্তা। বাকুপতিরাজের গৌড়বহে ভাগ-কালিদাস হরিচন্দ্রের সাথে, মাঘের শ্রীকণ্ঠচরিতে মেষ্ঠ ভারবি বাণের সঙ্গে সুবন্ধুর নাম উল্লিখিত হয়েছে। আলঙ্কারিক বামন তার কাব্যালঙ্কারে সুবন্ধুর রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন —- ‘ন্যায়স্থিতিমির উদ্যোতকর স্বরুপা বুদ্ধসঙ্গতিমিবালঙ্কারভাষিতাম্। সুবন্ধুর এই রচনা থেকে অনেকে মনে করেন যে সুবন্ধু উদ্যোত কার এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্য ভাগে ধর্মকীর্তি রচিত বুদ্ধসঙ্গতির উল্লেখ করেছেন। ফলে ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে সুবন্ধু আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
বাসবদত্তার নায়ক কন্দপকেতুকে দেখে বাসবদত্তার অবস্থা কবি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার সাথে ভবভূতির ‘মালবীমাধব প্রকরণের অংশবিশেষের সাদৃশ্য থেকে সমালোচকগণ মনে করেন সুবন্ধু ও ভবভূতির মধ্যে একটা পৌর্বাপর্য সম্পর্ক রয়েছে। এ যদি সত্য হয়, তবে সুবন্ধু কোন অবস্থাতে সপ্তম শতকের মধ্যবর্তী হতে পারে না।
বাসবদত্তার আখ্যানে দেখা যায় রাজা চিন্তামনির পুত্র কন্দপকেতু স্বপ্নে পরমাসুন্দরী এক কন্যাকে দেখে তাঁর অনুসন্ধানে বন্ধু মকরন্দের সাথে গৃহত্যাগ করেন। এক শুক দম্পতির কথার অনুসরণে নায়ক কুসুমপুরে উপস্থিত হন। সেখানে ঘটনা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাজা শৃঙ্গার শেখরের কন্যা বাসবদত্তার সাথে কন্দপকেতু মিলিত হন। আখ্যানে মুখ্য কাহিনীর সমান্তরালভাবে মকরুদ ও তমালিকার প্রেম কাহিনীও এগিয়েছে।
বাসবদত্তা কবি সুবন্ধুর মানসী, প্রতিমা। শব্দভাণ্ডার, ভাববর্ণন, অলঙ্কার পরিপাটি সমৃদ্ধ বাসবদত্তা নিঃসন্দেহে এক উৎকৃষ্ট গদ্যকাব্য। পরবর্তী গদ্য কবি বিশেষতঃ বাণভট্টের রচনায় গল্পের গলিপথে পাঠকের যেমন একটা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, সুবন্ধু বাসবদত্তায় সেদিক থেকে যথেষ্ট সতর্ক। তাঁর বাচনভঙ্গী যেমন সহজ, ভাষাও তেমনি, প্রাজ্জ্বল। নগর-পর্বত, কন্দপকেতুর স্বপ্নবৃত্তান্ত প্রভৃতি ব্যাপারে কবির বর্ণনা শক্তি প্রশংসনীয় হলেও দীর্ঘায়িত বর্ণনায় অনেকসময় পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি হয়। দণ্ডীর কাব্যে যে হাস্যরসের অবতারণা দেখা যায়, সুবন্ধুর রচনায় তা কিছুটা অনুপস্থিত। আখ্যানভাগে কবি নিঃসন্দেহে নব উন্মেশশালিনী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। শ্লেষ ও বিরোধাভাস অলঙ্কারের প্রাচুর্য কাব্যপাঠের আনন্দকে মাঝে মধ্যে বিঘ্নিত করেছে। অধ্যাপক দাশগুপ্ত এবং দে সুবন্ধু এবং বাণভট্টের রচনা রীতির তুলনামূলকভাবে আলোচনা করতে গিয়ে